আহসান হাবিব : [১] জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, তার সুইসাইডাল নোটটা পড়লাম। খুবই হাস্যকর লাগলো। প্রথম লাইনেই ছেলেটি লিখেছে সে সবকিছুর উত্তর পেয়ে গেছে, যা সে জীবনভর খুঁজেছে। সে ধ্যানরত অবস্থায় এমন এক জগতে ঢুকে পড়েছে, যা তার কল্পনার বাইরে এবং সে এটার বর্ণনা দিতে পারবে না। ওই অবস্থায় সে যা অনুভব করেছে তা হলো তার ভেতরে যে আত্মা আছে, তা শরীর থেকে বিযুক্ত হয়ে অন্তহীন কালের দেখা পেয়েছে এবং এই পাওয়াটাই তার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব বলে মনে হয়েছে। ফলে শরীর তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে এবং এই দার্শনিকতার ভিত্তিতে সে জীবনের চাইতে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেছে কারণ মৃত্যু ছাড়া আত্মার মুক্তি নেই এবং আত্মা ছাড়া ওই অনন্তকালের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। সে আত্মহত্যা করে ফেলেছে।

[২] নতুন কি আছে তার দর্শনে? কিচ্ছু নেই। সেই ভাববাদী হ্যালুসিনেশন ছাড়া। অপ্রকৃতস্থ বা মনোবিকলনের ফলে একজন মানুষ এই বিভ্রমে আক্রান্ত হতে পারে। তার এই চিন্তা ধর্ম প্রভাবিত। আত্মার ধারণাটি ধর্ম থেকেই এসেছে। ধর্মপ্রচারকরা এই আত্মাকেই তার হাতিয়ার করে যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত এবং বোকা সাজিয়ে এসেছে। এখনো পৃথিবীর বহু মানুষ এই দৃষ্টিভ্রমে আক্রান্ত। জীবনের উদ্দেশ্য কি, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মানুষের একটি সহজাত এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাস্য। এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ নিজের নিজের মতো করে পেয়েছে। ধর্ম এসে মানুষের অসহায়তা এবং অজ্ঞানতাকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করে গেছে এবং এখনো চলেছে।

জীবনের উদ্দেশ্য প্রকৃতপ্রস্তাবে কিছু নেই। কারণ তার উদ্ভবে তার নিজের কোনো হাত নেই। এটা সম্পূর্ণ প্রকৃতির অভিপ্রায়। আর প্রকৃতির অভিপ্রায় হচ্ছে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে টিকে থাকা এবং তার এই টিকে থাকাকে উপভোগ করা। ধর্ম এসে বাগড়া দিলো, তার উপভোগের পথে কাঁটা পুঁতে দিলো। সেই কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে চলেছে পৃথিবীর অজ্ঞ মানুষেরা। তার বলি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছেলেটি।

[৩] আত্মহত্যা এক প্রকার পলয়নপরতা। পরাজিত এবং দুর্বল চিত্তের মানুষ আত্মহত্যা করে। সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের অভাব থেকে তৈরি হয় মনোবিকলন যা আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে। স্বাভাবিক চিন্তা থেকে তারা দূরে সরে যায় এবং বিকৃতি তাদের পেয়ে বসে। দর্শনের বিবর্তনপথটা কেউ যদি ঠিকমত আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে চিন্তা আপটুডেট হয় না, পশ্চাৎপদতা তাদের চিন্তাকে ঘিরে থাকে। চেতনাকে বস্তুনিরপেক্ষতা থেকে বস্তুজাতয় স্থাপন মানব জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ছেলেটির আত্মহনন পশ্চাৎপদ চিন্তার ফসল। লেখক: ঔপন্যাসিক